অরুণ কুমার বিশ্বাস এর গল্প ভালোবাসা ছায়াছবি নয়

এক

শাহেদ, আমি তোমায় খুন করবো, বুঝলে!
কথাগুলো ছিটকে এলো সেলফোনের ওপার থেকে। ভাগ্যিস এসেছিল, শাহেদ নইলে কী করতো বলা কঠিন। আর এই খুনোখুনির বিষয়টি নেহাতই আবেগসঞ্জাত, তাই সিমি নামের যে মেয়েটি কথাগুলো বলল, তার বুকে চেপে ছিল অভিমানের নিরেট পাহাড়।
খুন করবে! তো করে ফেল! কবির মতো তুমিও ভালোবেসে খুনি হয়ে যাও। আর আমি নিজেকে হারাই তোমার ভালোবাসার ফল্গুধারায়। ফোন কেটে দেয় শাহেদ। সিমিও নির্বাক বসে থাকে। যেন কিছু বলবার নেই আর।
ওদের সম্পর্কের শুরুটা আসলে একটা ভুল থেকে। নীলক্ষেতে লেকচার শিট ফটোকপি করতে গিয়ে সিমির সাথে শাহেদের চেনাজানা হয়। কথা নয়, আসলে বাদানুবাদ। সিমির খুব তাড়া ছিল তাই বলল, মামা, আমার ফটোকপিগুলো এক্ষুনি একটু করে দেয়া যাবে? ডানগালে টোল ফেলে সিমি একটু হাসলোও। ব্যস, মামা মাথা নাড়লো, এবং শাহেদ লাইনে থাকা সত্তে¡ও সিমির কপিগুলো জেরক্স করতে থাকলো।
শাহেদের খুব আঁতে লাগে ব্যাপারটা। সেও দেখতে কিছু কম সুন্দর নয়! বলল, এটা কী হল! দেশে কি আইন-কানুন নেই নাকি! আমারটা বাদ দিয়ে…!
কথা শেষ হয় না শাহেদের। সিমি স্বরে উষ্মা মিশিয়ে বলে, ওকে বাবা, আমারটা থাক। ওরটা আগে করে দাও। ফটোকপিঅলাকে কিছু বাড়তি কথাও বলল সিমি। এ যেন ঝিকে মেরে বৌকে শিক্ষা দেবার মতো।
তাতে শাহেদের খানিক লজ্জাবোধ হয়, বা মর্মপীড়া। এভাবে সে না বললেও পারতো। সামান্য ব্যাপারটা বেহুদা কেমন অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো।
বলল, স্যরি। আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি। আপনার নিশ্চয়ই খুব তাড়া ছিল। নিজেকে সামলায় শাহেদ। ওর চোখে কিছু অপরাধবোধ বা অপ্রস্তুত ভাব দেখে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয় সিমি। আর সেখানেই গোড়াপত্তন হয় ভাবিকালের কোন এলোমেলো সম্পর্কের। সিমি আর শাহেদ একই রিকশায় ক্যাম্পাসে এসে নামে। ওদের সেলনম্বর টোকাটুকি হয়। এবং এভাবেই সিমি ক্রমশ শাহেদের চিন্তা ও চেতনার অনেকখানি জায়গা দখল করে বসে।

দুই.
তারপর টিএসসি, কলাভবন, কার্জন হল হয়ে ওঠে ওদের বিচরণের উন্মুক্ত আকাশ। যেন নিটোল দিঘিজলে একজোড়া রাজহংসের অবাধ সাঁতার। সিমি মেরুন টিপ আর দুধসাদা জমিনে অভ্রনীল পাড় শাড়ি পরে টিএসসির ঘেসো কার্পেটে এসে বসলে শাহেদ আর চোখ ফেরাতে পারে না। অপলক চেয়ে থাকে, চেয়েই থাকে। সম্পর্কের বুনন ক্রমশ গাঢ় হয়, প্রগাঢ় ভালোলাগায় সিক্ত হয় সিমি ও শাহেদ। এই মর্মে তারা আশ^স্ত হয় যে, ছোট্ট জীবনের বাকি দিনগুলো না হয় দুজন দুজনকে চিনে নিতেই কাটিয়ে দেবে। ওরা একে অপরের নিঃশ্বাসে বিশ্বাসের খোঁজ পায়, এবং নিষ্করুণ নাগরিক জীবনে এক টুকরো স্বপ্নসৌধ গড়বে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।
এই, আমি তোমার কে বলো তো? আবেগমথিত সুরে সিমি বলল।
ইউ মিন এন্টায়ার ওয়ার্ল্ড টু মি, সিমি। তোমাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারছি না! শাহেদ ওর আবেগের ভাগিদার হয়। যেন আগুনে ঘি, দুজন দুজনকে পোড়ায়, তবে কষ্ট হয় না।
সত্যি বলছো? সিমি ওর শাড়ির আঁচলে অকারণ আঙুল জড়ায়।
সিরিয়াস বিষয়ে আমি কখনও মিথ্যা বলি না সিমি। তুমি জানো, তুমি কাছে না থাকলে আরো বেশি করে ‘তুমি’ থাকো আমার কাছে!
সিমি কী বুঝলো কে জানে! শাহেদ অবাক হয়ে লক্ষ করে, সিমির চোখে জল। সিমি কাঁদছে।
ছি! কাঁদছো কেন সিমি? কী হল? আমি কি ভুল কিছু বললাম!
উত্তরে ও কিছু বলে না। শুধু দুজনের মাঝে তখনও বিদ্যমান দূরত্বটুকু অতিক্রম করে ওরা। সিমি প্রায় ওর কাছঘেঁেষ বসে। অথচ কিছু বলতে পারে না। বলার প্রয়োজনও পড়ে না কোন। যেন নৈঃশব্দ্য হিরন্ময়। শাহেদ যা বোঝার ঠিক বুঝে নেয়। ভাবের গভীরে ভাষার প্রয়োগ বরাবরই অনর্থক।
সবার অলক্ষ্যে সিমির চিবুক স্পর্শ করে শাহেদ বলল, তুমি না, বড্ড ছেলেমানুষ! লোকে কী ভাববে বলো তো! অপ্রস্তুত শাহেদ। কেউ হয়তো দেখেও ফেলেছে।
পরের গল্পগুলো মোটামুটি সবার জানা। টিপিক্যাল লাভস্টোরি বলা যায়। সময়ের সাথে সাথে সিমি ও শাহেদের সম্পর্কে দানা বাঁধে। কলাভবনে ওরা ক্রমশ দ্রষ্টব্য জুটি হিসেবে পরিচিতি পায়। ক্লাস শেষ করেই উধাও হয় সিমি। মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসা ছেড়ে সে আবাসিক হলে ওঠে, শাহেদের সাথে যাতে চুটিয়ে প্রেম করতে পারে। অন্ধ প্রেম! ওরা একে অপরকে ছাড়া আর কিচ্ছু দেখতে পায় না। এ এক অদ্ভুত প্রেমের চশমা। তুমি ছাড়া সব অন্ধকার।

তিন.
আচ্ছা সিমি, আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করবে তো!
কিসের অপেক্ষা?
এই যদি ধরো চাকরি পেতে একটু দেরি হয়!
হলে হবে। তুমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছো না। তোমার জন্য আমি শুধু বছর নয়, যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে পারি। চাই কি নিরন্তর প্রতীক্ষা করবো আমি।
প্রমিস! শাহেদ তখন উন্মাদনায় হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। সিমির বাইরে ওর যেন আর কোন জগত নেই। নইলে সে বুঝতো, প্রণয়াভিসারে কিছু কথা আছে, যা ঠিক কথা নয়, ক্লিশে। বা বলা যায় প্রেমিক-প্রেমিকার বাইবেল। এসব কথা অনিবার্যভাবেই আসে, আসবেই।
সিমি আরো নিবিড় হয়। পারলে যেন শাহেদকে মুড়ি দিয়ে জড়িয়ে থাকে সিমি। বুকের ভেতর কেমন এক অজানা শিরশিরে অনুভূতি হয় ওর। কষ্ট কষ্ট সুখ! নাকি সুখের অসুখ! সিমি কোন এক দুর্বল মুহূর্তে ভাবে, শাহেদ তাকে ছেড়ে যাবে না তো! কোনদিনও!
ভাবনাটা পারস্পরিক। ঠিক সন্দেহ নয়, আবার অটুট আস্থাও বলা যাবে না। বিশেষত শাহেদ আর সিমির আর্থিক অবস্থান সমানুপাতিক নয়। সিমির বাবা প্রতিষ্ঠিত বিজনেসম্যান। ওর ঠাঁটবাট অন্যরকম। শাহেদ মিডল ক্লাস। নি¤œ-মধ্যবিত্ত বলা চলে।
এতে কিছু ঠোকাঠুকিও হয়। এই যেমন, সিমি গাড়ি চড়তে স্বচ্ছন্দবোধ করে। কারণ সে এতে অভ্যস্ত। অথচ শাহেদ জীবনে একবারই ওর এক বন্ধুর গাড়িতে চেপেছিল। তাও মিনিট কয়েকের জন্য।
একদিন হালকা চালে শাহেদ বলল, ভেবে দেখো সিমি, আমার সাথে তুমি থাকতে পারবে তো! উই আর নট সো পশ এন্ড পাওয়ারফুল! আমার দুচারটা চাপরাশ নেই।
সিমি অমনি অভিমানী পায়রা হয়ে যায়। দুচোখে বৃষ্টির ঘ্রাণ মেখে বলে, আমায় তুমি এই চিনলে! আমি আভিজাত্যের পরোয়া করি না শাহেদ। আমি শুধু তোমাকে চাই। কিচ্ছু নয় আর। নাথিং।
স্বস্তি পায় শাহেদ। নতুন আশায় বুক বাঁধে। স্বপ্নটা ওর খানিক বেশিই। ও ভাবছে সিমি মেয়েটা তাকে যেভাবে বোঝে, আর কেউ এভাবে বুঝবে না। জীবনটাই হল বোঝাপড়া। অথবা বলা যায়, আর্ট অফ কমপ্রোমাইজ। মেনে নাও, মানিয়ে নাও। ফরগিভ এন্ড ফরগেট। প্রতিযোগী হলে জীবন হয় না। উত্তুঙ্গ ভালবাসা তাতে নেই। লাইফ জাস্ট হেল হয়ে যায়। বা হেলে যায়।
সিমি শাহেদের তুলনায় একাডেমিক্যালি একটু জুনিয়র। আর গোলমালটা সেখানেই বাঁধে। ওদের সম্পর্ক যখন ক্রমশ পরিণতির দিকে গড়ায়, শাহেদ ব্যবসায় প্রশাসনে মাস্টার্স সম্পন্ন করে, তখন প্রশ্ন আসে গাঁটছড়া বাঁধার। কারণ সিমি আর অপেক্ষা করতে পারছিল না। চাপটা ছিল দুদিক থেকে- কুড়িতে মেয়েরা এখন যতই বুড়ি না হোক, বাবা-মায়েদের সেই মান্ধাতার আমলের বিশ্বাস কিন্তু অটুট এখনও। মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে, এবার দেখেশুনে একটা পাত্র খুঁজে আনো। মেয়েকে বিদায় করি।
সিমির মা অবশ্য ততটা রগচটা নন। তিনি সিমির সম্পর্কের কথা শুনে শুরুতে খুব বাগড়া দেননি। বরং প্রশ্রয়ের সুরে বললেন, যা না, একদিন নিয়ে আয় বাসায়। দেখি কেমন তোর পছন্দ!
বাহ্, বেশ ভাল কথা। কিন্তু সিমির বাবা হোসেন সাহেব ব্যবসাদার লোক। তিনি লাভ-ক্ষতির হিসাব বোঝেন। চট করে গিন্নির কথায় সায় দেননি হোসেন। বিশেষত যখন তিনি শুনলেন, ছেলে বেকার। মাত্রই পোস্টগ্রাড কমপ্লিট করেছে। পায়ের নীচে মাটি বলতে যা বুঝায় তা তার নেই।
সিমি আব্দারের সুরে বলল, বাপি, শাহেদ অনেক মেধাবী। ও চাকরি পেয়ে যাবে।
হোসেন সাহেব মাথা নাড়লেন। তা হয়তো পাবে, কিন্তু মা, শুঁড়ির পক্ষে মাতালেরা চিরকালই সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে। তাই তোমার যুক্তি আমি মানতে পারছি না। স্যরি।
শাহেদ সব শুনলো। খুব আঁতে লাগলো তার। মিডল-ক্লাস লোকেদের এই এক সমস্যা। এরা একটুতেই রেগেমেগে যা নয় তাই করে বশে। মানে আবেগের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং এরা খুব সহজে আবেগতাড়িত হয়।
সিমির সাথে তার বাপির বরাবরই সহজ সম্পর্ক। আব্দার-আহ্লাদে খুব একটা না করেন না। হাকিম হিসেবেও তিনি বেশ কঠিন। একবার না করলে তাকে হ্যাঁ করানো প্রায় অসাধ্য।
ভেঙে পড়লো সিমি। শাহেদকে ঘিরে তার সকল স্বপ্ন এবার ভূলুণ্ঠিত হবে। ওকে হয়তো আর পাওয়াই হবে না।
খুব মধ্যবিত্তের মতো শাহেদ নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো। মানে সিমির সাথে নিজেকে ওর জড়ানোই ঠিক হয়নি। বামুন হয়ে চাঁদে হাত!
সিমি একটু শক্ত ধাতুতে গড়া। মাকে সে বোঝালো, ছেলেটা ভাল। সবচে বড় কথা, শাহেদকে সে কথা দিয়েছে। খেলাপ করতে পারবে না।
মা কিছু বললেন না। সিমিকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। সিমির বদলে তিনি স্বামীকে বোঝানোর উদ্যোগ নিলেন। যদিও তিনি জানেন, ওই গোঁয়ার প্রকৃতির লোক কিছুতেই হার মানবেন না। সংসারে ঝড় উঠছে। সামনে ঘোর বিপত্তি।

চার.
হোসেন সাহেবের অফিস। অনেকটা ছায়াছবির মতোন শাহেদ সেখানে উপস্থিত। মেয়েকে দিয়ে তাকে ডেকে এনেছেন তিনি।
হোসেন সাহেব ঘোড়েল বিজনেসম্যান। সহজে উত্তেজিত হন না। শাহেদকে তিনি বোঝালেন, জীবনটা কোন ছেলেখেলা নয়। আবেগ-অনুভূতিও চিরস্থায়ী নয়। বরং সময় গড়ানোর সাথে সাথে আবেগে পানি ঢোকে। মানুষ মূলত আবেগের চেয়ে সংস্কারে বিশ্বাসী হয়। চাইলেও সিমি তোমার সাথে তাল মেলাতে পারবে না। তুমি বরং কেটে পড়ো।
কেটে পড়বো মানে! আই লাভ হার! উইদ অল মাই হার্ট।
হৃদয় দিয়ে ভালোবাসো? হৃদয়টা কোথায়, দেখাও তো! কৌশলী হন হোসেন সাহেব।
শাহেদ কিছু বলে না। আফটার অল সিমির বাবা। তাছাড়া তার অভিজ্ঞতা কম। প্যাঁচটা কিভাবে কষছেন, ও ধরতে পারে না।
দেখাতে পারলে না তো! তাই বলছিলাম, বাস্তবতা মেনে নাও। আখেরে ভাল হবে। তুমি মেধাবী ছেলে, মাথাটাও খাটাও একটু। শুধু আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।
আবেগ ছাড়াও চলে না আঙ্কেল। ফস্ করে বলে বসলো শাহেদ। আপনি বরং আপনার মেয়েকে বোঝান।
আমি তাকে ওষুধ দিয়েছি। ওষুধের কাজ করা না-করা নির্ভর করছে তোমার উপর। নিরুত্তাপ ঠাণ্ডা স্বরে হোসেন সাহেব বললেন।
আমার উপর! হাউ কাম! প্রেম আমি একা করিনি, আপনার মেয়ে সিমিও করেছে। তাকে জিজ্ঞাস করুন, আমাকে ছাড়তে রাজি কি না!
হুম! আই মাস্ট ট্রাই। হোসেন সাহেব কী যেন ভাবছেন।
এর পরের পর্বটা ছায়াছবিতে রূপ নিতে পারতো। এই যেমন সিমির বাবা শাহেদকে লোভনীয় কোন চাকরি বা নগদ অর্থের লোভ দেখাতে পারতেন। বা প্রাণের হুমকি! এর কোনটাই তিনি করেননি। হোসেন সাহেব জানেন, পুরো পরিস্থিতিটা শাহেদ একা ক্রিয়েট করেনি, তার মেয়ে সিমিরও যথেষ্ট অবদান আছে। মেয়েটাও হয়েছে তার মতোই বেয়াড়া। সহসা ময়দান ছাড়ে না।
সিমির বাবা শাহেদকে সুগন্ধী কফি অফার করলেন।
নো থ্যাঙ্কস। বেরিয়ে এলো শাহেদ। এখানে সে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসেনি। বা সিনেমার সেটও নয় যে পরিচালকের ইশারার অপেক্ষায় থাকবে। সে জীবনের বোঝাপড়া করতে এসেছিল।
পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিত, তবে তাৎপর্যহীন নয়। অতি আবেগি মেয়ে সিমি শাহেদের সাথে পত্রপাঠ দেখা করলো। সখেদে বলল, আমার বাপটা একটা কসাই, বুঝলে শাহেদ। তার মন বলে কিছু নেই।
তো! আমি কী করবো! তুমি কী চাও, তোমার বাবার চাপতির নিচে নিজেকে মেলে ধরি! বড্ড ম্রিয়মাণ শোনায় শাহেদকে।
তুমি বলো কী করবে!
শাহেদ চুপ।
লিস্ন টু ই্ওর হার্ট!
শাহেদ তাও চুপ। যেন কিচ্ছু বলার নেই তার। এমন মেনিমুখো ছেলে সে আর দেখেনি।
চলো পালাই! সিমি বলল। ওর চোখে উৎসাহ। যেন শেষ চেষ্টা।
কোথায় পালাবে! মনে রেখ, এটা সিনেমা নয়। যাপিতজীবন।
যেদিকে দুচোখ যায়।
আবার সিনেমা! শাহেদের কণ্ঠে কান্নার আভাস।
দেখো, দেখো ছেলে, কান্না তোমায় মানায় না। পালানো ছাড়া পথ নাই। কী করবে ভাবো।
অসফল দেখাশুনা। শাহেদ চুপ, সিমির চোখে কান্না। কিন্তু কান্না কোন সমাধান নয়। তবে কি ওরা হেরে যাবে! বাংলাছবির শেষ সংলাপ- লেট্স লাভ এন্ড ডাই টুগেদার, নট টু কাম এগেইন।

পাঁচ.
প্রায় তিনমাস পর।
শাহেদ এখন বেহেড মাতাল। না না, বোতলে আসক্ত সে নয়। তাতে টাকা লাগে। সিমিকে সে ভুলতে চায়। নতুনভাবে জীবন শুরু করবে। যেখানে মগজের কারবার আছে, হৃদয়ের নাকি-কান্না নয়।
ফোন এলো একরাতে।
কে?
সিমি বিরক্ত। বলে, আমার ফোন নাম্বারটাও ডিলিট করে দিয়েছ! বাহ, খুব ভালো।
তুমি! বলো, কেন ফোন করেছ?
তোমার মুণ্ডু খাবো, তাই। সিমির কণ্ঠে তারল্য। শাহেদ চুপ। ওদিকে নো রেসপন্স।
বিয়ে ঠিক হয়েছে! কার্ড পাঠাবে?
ধরো তাই।
দরকার নাই। আমি শোক উদ্যাপন করি না।
বলেছি না মুণ্ডু খাবো। চিবিয়ে। কচকচ করে। সিমি বলল। ও আসলে কিছু বলতে বা বুঝতে চায়।
হেঁয়ালি না করে বলো, কেন ফোন করেছ! নিস্পৃহ শাহেদ।
তুমি কেমন আছো শাহেদ?
এই তো আছি এক রকম। বেঁচে আছি। নিরুত্তাপ কণ্ঠ ব্যর্থ প্রেমিকের। ঠিক করেছি, আমি পালাবো।
আমাকে নিয়ে? সিমি যেন স্কুলপড়–য়া মেয়ে। হো হো করে হাসছে।
না, একাই। আমি কারো ভার বহনে অক্ষম। তেতো গলায় শাহেদ বলল।
আমি তোমাকে খুন করবো শাহেদ। মাইন্ড ইট। প্রেম করে একা পালাবে তা হয় না। আমি না পেলে তোমাকে আর কারো হতে দেবো না। প্রমিস।
বোকামি করো না। তোমার বাবার কথাই ঠিক। এটা বাস্তব, সিনেমা নয়। তুমি ভালো থেকো। যেন গুডবাই বলে দিচ্ছে শাহেদ।
ঠিকই তো। বাবাই তো বলেছেন, তাকে আসতে দাও, কথা বলি। মা সিমি, এই প্রথম আমি তোমার কাছে হার মানলাম। বুঝতে পারছি, ছেলেটা কপট নয়। তোমার ভালবাসাও নির্ভেজাল। ইস্ ঘরে ঘরে যদি এমন বাবা হত! প্রায় একশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল সিমি।
সত্যি! আঙ্কেল এসব বলেছেন! শাহেদ যেন শূন্যে লাফিয়ে উঠলো। ওর রক্তে অ্যাড্রেনালিনের ভয়ানক দাপাদাপি। যেন লাভ-হরমোন ব্যাঙের মতোন লাফিয়ে উঠছে মগজে। শাহেদ সত্যি আত্মহারা।
ও শুধু বলল, আমি আসছি। আজই। এক্ষুনি।
ইয়েস, ট্রু লাভ নেভার ডাইজ। ভালোবাসা রয়ে যায়, খাঁটি সুগন্ধীর মতো। অবেগে পাক খায়, বেঁচে থাকে, বাঁচিয়ে রাখে। অযুত বছর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *