ঈদ সংখ্যা ২০২০ এর গল্প//নক্ষত্রের আগুন ভরা রাত//ইকবাল হাসান

এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন আফজালুর রশীদ।

শ্রাবণ সন্ধ্যায় তার শয্যা পাশে রচিত দৃশ্যটির কলা-কুশলীদের প্রায় সবাই পরিচিত, একমাত্র নতুন মুখ অরণ্য ছাড়া। অরণ্যকে চিনতে পারলেন কি পারলেন না, যদিও রুমের ভিতর পর্যাপ্ত আলো উপস্থিত, রিনা ও তৃনার মাঝখানে তবু যেন দন্ডায়মান অন্ধকার দেখলেন তিনি। এখন অবশ্য
আলো না অন্ধকার, রিনা না তৃণা, শ্রাবণ না ভাদ্র এসবে তাঁর আর কিছুই এসে যায় না। এমন কি এই যে মাথার পার্শ্বে গুনগুন করে কোরআন পাঠে নিমগ্ন তার স্ত্রী, মারুফা বেগম যাকে তিনি বাবা-মা’র আদেশে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন একদা, খুব নিম্নস্বরে একক কেঁদে চলেছেন, এককভাবে এই কারনে যে, অন্যদের ঠোঁট সামান্য সামান্য নড়াচড়া করছে যদিও, তবে তাদের কান্না করার যথার্থ কারণ এখনো তৈরি হয়নি বলে সবার দৃষ্টি ইতস্ততঃ ভাসমান এবং সবাই নিম্নস্বরে কিছু না কিছু বলছে হয়তো, ফলে সব কিছু মিলেমিশে যেন দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক ক্রমাগত শুনতে পাচ্ছিলেন আফজালুর রশীদ। এই ঝিঁঝির ডাক যা তিনি আকাশভরা তারার আলোর নীচে যে লাউয়ের মাচান, ঘাস, ভাটফুল আর বিষখালির তীরে তাদের যে গ্রাম, সেই গ্রামদেশে শুনেছিলেন বাল্যকালে, কৈশোরে ও যৌবনে, পরবর্তীতে যেখানে আর তাঁর যাওয়া হয়নি তেমন, সেই ডাক তাঁকে নিমগ্ন করলে পুনরায় চোখ বন্ধ করলেন তিনি। আবার সেই অতি পরিচিত প্রাণহীন অপ্রিয় অন্ধকার। যার কোনো উপরিতল নেই, ঘুটঘুটে, পারদের মতো ভারী, অমাবস্যার মতো জটিল ও রহস্যময়, তাঁকে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত আশ্চর্য এক টানেলের দিকে। আর এদিকে কলা-কুশলীরা, যারা এতোক্ষন শয্যার চারপাশে ছিলেন স্থির ও দন্ডায়মান, আফজালুর রশীদ পুনরায় চোখ বন্ধ করতেই, সামান্য বাতাসে গাছপালা যেমন, তারা নড়েচড়ে উঠলেন।

কেউ কেউ ভিতরে ভিতরে ভীষন বিরক্ত যখন, যদিও অবয়বে এধরনের অপচ্ছবি অনুপস্থিত রাখতে যারপরনাই চেষ্টারত তারা, নাটকে যেমন হয় এবং তা দেখে মারুফা বেগম তখন, যিনি কান্নাজড়িত কোরআন পাঠে নিমগ্ন ছিলেন এতোক্ষন, বললেন, ‘তোমরা সবাই যাও। কাউকে থাকতে হবে না। রাতে আজ আমি একাই থাকবো।’ একথা শুনে যেন কন্ঠে কিছুটা হাহাকার এনে ম্যাক আলী, অনেকটা যেন ভিত্তিপ্রস্তরে নাম ফলক লাগালেন, বললেন, ছি ছি মা ! একি কথা বললেন! আমরা
এতোদূর থেকে ছুটে এসেছি, মানে এই নিয়ে তিনবার তো এলাম আব্বার ইন্নালিল্লাহের সময় পাশে থাকবো বলে। আর আপনি বলছেন চলে যেতে, রাতেই যদি খবর হয়ে যায়…, আরো কিছু বলতে

যাচ্ছিলো ম্যাক আলী ওরফে মোবারক আলী, তাকে চোখের ইঙ্গিতে থামালো দ্বীনা। এবার সত্যি সত্যি বুঝি রেগে যান মা, এইভেবে তৃনা ও অরণ্যকে রেখে অন্যদের নিয়ে বাইরে এলো সে।

২.
এই আহাম্মক, ম্যাকের বাচ্চা…
দ্যাখো দ্বীনা, আমি ম্যাকের বাচ্চা নই। আই এ্যাম দ্যা ম্যাক।
শাট আপ! তোমার মতো একটা ছাগলকে বিয়ে করাই আমার ভুল হয়েছে। এতো টাকা পয়সা খরচ করে বাবার অসুখের কথা শুনে কাজ-কাম ফেলে রেখে আমরা সুদূর মিশিগান থেকে ছুটে এসেছি, তার মূল্য তুমি কি রাখলে ?

ছি ছি, মা কী মনে করলেন ! অইভাবে কেউ বলে, আমরা আব্বার ইন্নলিল্লাহে দেখতে এসেছি…, রাতেই যদি খবর হয়ে যায়…, ও মাই গড ! অরণ্য’র মতো একটা বাচ্চা ছেলে, সেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো তোমার দিকে।
অরণ্য ইজ নো মোর এ বাচ্চা ছেলে। আর কিছুদিন পর সে তোমার সিসটার তৃণাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
তুমি তো দেখছি আমাকে পাগল বানিয়ে দেবে। নো মোর টকিং, তুমি যদি আর একটা কথা বল আমি তোমার জান খেয়ে ফেলবো, আই প্রমিজ।
ওকে ওকে, সুইট হার্ট। নো মোর টকিং। আমি এখন ক্লাবে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে আমার ডাবল-সট স্কচ দরকার।

উপরুল্লিখিত সংলাপ বিনিময় শেষে হাসপাতালের লবি থেকে ম্যাক আলী নিস্ক্রান্ত হলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে দ্বীনা। স্বামী নামের এই এক জজ্ঞালের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে সে। পুরুষ মানুষ যে এতোটা বেকুব হয় তার জানা ছিল না। কোন পরিস্থিতিতে কী কথা বলতে হয় তা যেন ওর বোঝার বাইরে।
গতকালও এনিয়ে এক রাউন্ড হয়ে গেছে। আমার বাবার নাকি কৈ মাছের প্রাণ, তিনি নাকি কুমিরের আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন। হারামজাদা চায় আমার বাবা এক্ষুনি মরে যাক। বলল, আব্বার তো ছিয়াত্তর আশির কাছাকাছি বয়স, ভালোভাবে হাটতে চলতে পারেন না, আই মিন, নাউ এ দুনিয়ায় বেঁচে থেকে কষ্ট না করে চলে যাওয়াই বেটার।

নিজের বাবা মরে যাবার সময় সে কথাটি মনে ছিল না তোমার? তুমি আমাকে দু’বছরে চারবার বাংলাদেশে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এসেছো। তোমার বাপের বয়স নব্বই হয়েছিল। বিছানাটাকে বানিয়ে ছিলেন টয়লেট, হাগামুতা করতেন বিছানায়, মনে আছে?

এসব ডার্টি কথাবার্তা কেন তুলছো দ্বীন? মৃত মানুষদের নিয়ে, আই মিন, যাদের ইন্নালিল্লাহে হয়েছে তাদের নিয়ে এভাবে বলা কি ঠিক?

দেন হোয়াট এবাউট মাই ফাদার?
আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। তাঁর তো বয়স অনেক…
কি বলতে চাও তুমি? আমরা বাবাকে মেরে ফেলবো? ট্রিটমেন্ট করাবো না? তোমার সমস্যাটা কি? হোয়াট্স ইওর প্রবলেম?
আই হ্যাভ নো প্রবলেম। এবার যদি একটা কিছু না হয় দ্বীন, এভাবে বারবার তো আর আসা সম্ভব নয়।
তোমাকে তো কেউ দিব্যি দেয়নি যে আসতে হবেই। তুমি কি আমার বাবার জন্যে এসেছো? তুমি
এসেছো তোমার ব্যবসার ধান্ধায়। ভন্ড কোথাকার!
ব্যবসার কথা ওঠায় নড়েচড়ে ওঠে ম্যাক আলী। তার আচরনে হঠাৎ ধরা পড়া আসামীর কাচুমাচু ভাব। সে চুপ থাকা সাব্যস্ত করে।

কথা বাড়ায় না আর দ্বীনা।

৩.
পুনরায় চোখ মেলে তাকান আফজালুর রশীদ।

তাঁর শয্যা পাশে কেউ নেই, দেখেন যে, বাইরের আকাশে জোনাকি আলোর মতো জেগে আছে নক্ষত্রেরা। রাত কতো হবে বোঝার উপায় নেই। ঝিঁঝি’র ডাকটা এখন আকাশের ওপার থেকে ভেসে আসা মিহি সুক্ষ্ম অচেনা

একটি সুরের মতো বেজে চলেছে আর তিনি নিতান্তই একা, আধো ঘুম ও আধো জাগরনের ভিতর, চেতন-অচেতনের ভিতর মাকড়সার আশ্চর্য জালে আটকা পড়ে আছেন যেন। রুমের ভিতর নীল আলো আর শব্দহীন চারদিক এবং বাইরে এমন নিস্তরঙ্গ সুনসান রাত, অন্ধকারেও বিড়ালের পায়ের পাতার মতো শাদা, যেনবা কার্তিকের ভরা জ্যোৎস্নাকেও হার মানায়।
যদিও একটু দূরে দেয়াল ঘেষে যে বসবার সোফা, সেখানে এখন মারুফা বেগম ঘুমে কাদা, তিনি অতি কষ্টে দেখেন যে, স্ত্রী মারুফার একখানা হাত মাচানে ঝুলে থাকা লাউয়ের মতো সোফার বাইরে
ঝুলে আছে। হাতখানা তুলে দিতে ইচ্ছে জাগে তাঁর, কিন্তু এমত অবস্থায়, বিশেষ করে হাত’পা নাড়ানোর ক্ষমতা না থাকায় দৃষ্টি তাঁর ক্রমান্ময়ে অস্থির ও ব্যাকুল।

এই ব্যাকুল, অস্থিরতা যেন তাঁকে একটু একটু করে নিজেকে নিজের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

কারো কারো চোখে মুখে উপকুলীয় বিপদ-সংকেতের উদ্বেগ, শয্যাপার্শ্বে নিবিড় কোলাহলের আতিশয্য তাঁকে মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দ্যায়, এবার বোধহয় আর ফিরে যাওয়া হবে না। এমন ভাবনা তাঁকে কিছুটাবা চিন্তিত করে

তোলে, তোলে কেননা, ছোট মেয়ে তৃণার বিয়ে তিনি দেখে যেতে পারছেন না। মারুফা বেগমকে চিকিৎসার জন্যে বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা হয়েছিল।
সাভারের জমি নিয়ে যে মহা ফ্যাকরা তৈরি হয়েছেÑতিনি চলে গেলে এই জট কে ছাড়াবে? তাঁদের
কোনো ছেলে নেই, এই তৃষ্ণা সারা জীবনের। তিনটি মেয়ে, বড় দু’টির বিয়ে হয়েছে, বিদেশে থাকে, কালেভদ্রে দেশে আসে। ওরা ব্যস্ত ওদের জীবন নিয়ে। ওদের সময় কোথায় অন্যদের নিয়ে ভাবার! আবার ভেবেছেন, মৃত্যুর কাছে এসব তো খুবই তুচ্ছ। কী এসে যায় এসবে! পৃথিবীতে কার জন্যে কোথায় কোন কাজটি আটকে পরে আছে! জীবন কোনো না কোনোভাবে চলে যায়ই।
তার ও কি চলে যায়নি? একটা জীবন কি তিনিও পার করে দ্যাননি? জীবনের কতো কিছুই তো থেকেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কতো আশা, কতো আকাঙ্খা, ইচ্ছে, স্বপ্ন সুতোহীন উড়তে উড়তে চলে গেছে দূরে! তার কতোটাই বা কেয়ার করেছেন তিনি।

আর এখন শয্যা পাশে কেউ নেই বলে, এসব অতি-প্রাকৃত জাগতিক চিন্তা আফজালুর রশীদের মাথা থেকে উধাও।

মৃত্যু নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নন তিনি। তবু মনীষীরা যেমন, মৃত্যুকে কেউ কেউ মনে করতেন, জীবনের বিষাদমাখা, আনন্দময় এক স্বাভাবিক পরিণতি, ‘মরন রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’ রবীন্দ্রনাথের এই আপ্ত বাক্যটি এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বার্নার্ড শ’ যেমন বলেছিলেন, ‘আমি ঘুমুতে চাই’ তাঁদের মতো তেমন করে ভাবতে পারেন না তিনি। সাধারন মানুষের মতো তাঁর ভাবনাও সাধারন। তবে অনেকের যেমন শেষ ইচ্ছে থাকে, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সবাই বলেন, অনেকের যেমন শেষ উচ্চারন ইতিহাসের অংশ হয়, মানুষ মনে রাখে বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী, মার্কসের কথা অবশ্য আলাদা, তিনি বলেছিলেন, লাষ্ট ওয়ার্ডস আর ফর ফুলস্ হু হ্যাভ নট সেইড এ্যানাফ, একটি শেষ ইচ্ছে তারও আছে, না তিনি কিছু বলে যেতে চান না, তাঁর বলার মতো আর কিছু নেই বলে, অন্তত বিদায় মুহূর্তটি যেন কেউ কান্নাকাটির অর্থহীন আতিশয্যে পরিবেশ বিষাদময় করে না তোলে। তিনি মরতে চান না রাজা চতুর্দশ ল্যুই’য়ের মতোন, যিনি মৃত্যুর সময়
তাঁর সেবিকাদের কাঁদতে দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা কাঁদছো কেন? তোমরা কি ভেবেছিলে আমার কোনোদিন মৃত্যু হবে না?’

নীলাভ আলোর ভিতর দিয়ে জানালার বাইরে যে আকাশ আর আকশের ওপারে অই যে দূরের সেই
ঘুটঘুটে অন্ধকারের বিশাল টানেল, জন্মের পর থেকেই মানুষের সঙ্গে সঙ্গে থাকা মৃত্যু নামের কুয়াশার হালকা একটা পর্দার মতোন, অই পর্দার ওপারের জীবনে চলে যাওয়া আফজালুর রশীদ, চলে যেতে চান নীরবে এবং নিঃশব্দে।

মৃত্যুকে তিনি জন ডানের মতোই বলতে চেয়েছেন: ডেথ, বি নট প্রাউড, দো সাম হ্যাভ কল দিই মাইটি এন্ড ড্রেডফুল, ফর দাউ আর্ট নট সো… ডাই নট, পুওর ডেথ; নর ইয়েট ক্যানষ্ট দাউ
কিল মি। তাঁর ছোট মেয়ে তৃনা জন ডানে’র ‘মৃত্যু’ কবিতাটি বহুদিন আবৃত্তি করে তাঁকে শুনানোর ফলে কিছু কিছু লাইন স্পষ্ট স্মরণ করতে পারেন তিনি। এখন তৃণা কাছে থাকলে আবৃত্তি করতে বলতেন কবিতাটি। তৃণার কথা মনে হতেই আফজালুর রশীদের আবছা মনে পড়ে, দ্বীনা ও রিনার মাঝখানে তিনি অন্ধকার ছায়ার মতো কাউকে দেখেছিলেন, দেখেছিলেন কি? সেই অন্ধকার ছায়া যেন দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দেবদারু বৃক্ষের মতো আকাশের দিকে উঠে গেছে। কে ছিল সেই অন্ধকারে দন্ডায়মান, কী ছিল সেখানে?
অই কি সেই আশ্চর্য টানেল, ঘনঘোর অন্ধকারের সূচনা? ভাবতে ভাবতে পুনরায় অস্থির ঘোলাটে হয়ে ওঠেন আফজালুর রশীদ।

৪.
শেষরাতের দিকে, আর একবার স্ত্রী মারুফা বেগমের দিকে তাকাতে চেষ্টা করেন। ঠিক তখন তিনি দ্যাখেন যে, তাঁর চোখের সামনে নেমে আসছে অপ্রতিরোধ্য অন্ধকার, আর তিনি সেই অন্ধকারের সাম্পানে চড়ে যেন এইমাত্র যাত্রা শুরু করলেন সম্পূর্ন এক ভিন্ন জগতের দিকে।
সহসাই দৃষ্টি তাঁর স্থির হয় জানালায়।

বাইরে তখনও নক্ষত্রের আগুনভরা রাত।

One thought on “ঈদ সংখ্যা ২০২০ এর গল্প//নক্ষত্রের আগুন ভরা রাত//ইকবাল হাসান

  • মে ২৪, ২০২০ at ৭:২৮ অপরাহ্ণ
    Permalink

    অভিভূত হলাম।
    দারুণ বর্ণনা!!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *