ফারুক আফিনদীর ‘হিম নাকি তাপিত রে মন’: কিছু নতুন কাজ।। আহমেদ উল্লাহ্

বহুমাত্রিক অর্থ প্রকাশে ব্যঞ্জনাময় শব্দগুচ্ছকে রসময় করে তুলতে পারলেই যদি হয় সফল কবিতা, তবে কবি ফারুক আফিনদীর কবিতাকেও সফল কবিতা হিসেবে আখ্যা দিতে কোনো প্রকার দ্বিধার সুযোগ নেই। ফারুক আফিনদীর ‘হিম নাকি তাপিত রে মন’ কাব্যটি এমনই কিছু সফল কবিতার সংযোজন।
শূন্য দশকের দোড়গোড়ায় লেখালেখি শুরু করা আফিনদীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হিম নাকি তাপিত রে মন’ প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় শব্দ ও ছন্দে ফুটে ওঠেছে পল্লিমাতৃকার শ্যামলরাঙা মুখ। গ্রামীণ বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য স্বচ্ছন্দে ভেসে বেড়ায় তার কবিতায়।
এই কাব্যের কবিতাগুলোর কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর ভর করে; নদী, বালুচর, ফসলের মাঠ, কৃষক কিষানি। নদী ও গ্রাম বাংলার সাথে কবির অন্তরাত্মার যে গভীরতম সুসম্পর্ক তা অনন্য রূপ-ছন্দে বিকশিত হয়ে ওঠেছে তার কবিতার শব্দ ও ছন্দে। বর্ষায় গ্রাম বাংলা সেজে ওঠে অনন্য রূপসজ্জায়। এমনই সৌন্দর্য ফুঠে উঠেছে কবির ‘একটা কর্ণফুল’ কবিতায়-
গত বর্ষায় একটা নিবিড় ধঞ্চের খেতে
আমার ভীষণ অভিভূত আত্মার
ডিঙ্গিটা নোঙর প্রকল্পে ব্রতী হলো
ধঞ্চের ফুল থেকে এলোমেলো রৌদ্র এসে…
এই কাব্যের বেশিরভাগ কবিতাই মুক্তক ছন্দে লেখা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় ব্যাপকভাবে। কিছু কবিতায় অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের মিশ্র প্রয়োগও রয়েছে। কিছু কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও ভাঙা পর্ব নেই। কবি কিছু কবিতায় ছন্দের চালে নিয়েছেন স্বাধীনতা। এসব কবিতায় দেখা গেছে কখনো সাত মাত্রার চাল, কখনো পাঁচ মাত্রার।
আফিনদীর কবিতায় রূপক, উপমার প্রয়োগ প্রশংসনীয়। ছন্দের বিচিত্র প্রয়োগ ও কবিতার ভাবধারায় অনন্য শৈল্পিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কবিতাগুলো পাঠের পাশাপাশি কবির মনোজগতের গভীর চিত্র বিকশিত হয়ে ওঠে। অদেখাকে দেখার, অজানাকে জানার মানবমনের যে শাশ্বত আকাক্সক্ষা; এর ইঙ্গিতও কতিপয় কবিতায় রূপকের ওপর ভর করে ফুটে ওঠেছে।
শহরের দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনেও কবি শুনতে পান গ্রামে বেজে ওঠা বাঁশির সুর। ‘গাঁওবাদী বাঁশির টানে উচাটন মন’ কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় নদীর পারে কিংবা বালুচরে বেজে ওঠা বিরহ প্রেমিকের বাঁশির সুর। গাওবাদী বাঁশির টানে কবির মন উচাটন হয়ে ওঠে। ওই বাঁশির সুর কখনো বেজে উঠে বাংলার অজোপাড়াগাঁয়ে ফিরে আসার আহ্বান, সবুজ শ্যামল মাঠের সাথে স্নিগ্ধময় মিলনের আহ্বান, কখনো বেজে উঠে প্রিয়জনকে কাছে পাবার প্রেমময় সুর হয়ে। ওই বাঁশি কিষাণীর মনেও বেজে উঠে স্বামীকে কাছে পাবার আকাঙ্খায়। জমিতে ফসল রোপণ করার পর যখন কৃষকের হাতে কাজ থাকে না, তখন ওরা শহরে চলে যায় কাজের অন্বেষণে। কার্তিকের ধান পাকলেই ওরা শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে আসে, ধানের টানে, এজন্য কবি পাকা ধানের সাথে বাঁশির সুরের তুলনা করেছেন, যা অনন্য উপমা। কবির ভাষায়-
জলযান কখন আসবে-
স্বামী আসবে, ধান পেকেছে ধান পেকেছে।
আমার বাঁশির রঙ পাকা ধান আমারও বাঁশিটার
মন কার্তিকের ধান,
গাঁওবাদী বাঁশির টানে উচাটন মন।
ফারুক আফিনদীর এই কাব্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় নতুনত্ব হলো টানা গদ্যে লেখা যতিচিহ্নহীন কবিতা, যা ইতোপূর্বে বাংলা কবিতায় আমার চোখে পড়েনি। এই কবিতায় যতির কাজটি তিনি সেরেছন ছন্দের সাহায্যে। একটা বাক্যে যেখানে যতিচিহ্নের প্রয়োজন হয়, সেখানে দেখা গেছে ছন্দের খাতিরেই থেমে যেতে হয়।
“সেদিনের খোপাটা খোলা এবং ভেজাগন্ধা কালো ওই নাওয়ের গলুইয়ে দাঁড়িয়েছেন উতরাল বাতাস তার কলাশরীর ভেদ করে যাচ্ছে তার চুল বাতাসে উড়িতেছে- বাঁশের পাতা- এবং এই বাতাসে বেহালার গীতিকা বাজে…”
গতিময় এই বিশ্বজগতের কখনো কোনো যতি নেই; সেই যে সৃষ্টির পর থেকে অনন্তের পথে ছুটে চলেছে, তো চলেছেই…
ফারুক তার কবিতায় অল্প শব্দের সুষম বিন্যাসে গভীর ভাবধারার ইঙ্গিত করেছেন।
আকাশে উপুর হয়ে আছে কড়াই
পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা গতি ঘি
একজন একাকে জোছনারা এভাবেই অত্যাচার করে
ফারুক আফিনদীর কবিতায় প্রকৃতিপ্রেম স্পষ্টভাবে বিকশিত হয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে কবি ফারুক আফিনদীর কবিতা স্বতন্ত্র এক ধারার ইঙ্গিত করে এবং প্রতিটি কবিতায় বিচিত্র চিত্রকল্প বিকশিত হয়ে ওঠে। কবিতায় নতুনত্বে¡র রূপদানের চেষ্টা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
ফারুক আফিনদীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- স্বতন্ত্র ধারার প্রকাশ। কবিতার পথ ও ধারাবাহিক পথ থেকে বেরিয়ে কবি নিজস্বতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তার কবিতায়। এই পথ সহজ নয়। কিন্তু কঠিন পথকেই তিনি সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন খুবই সাবলীলভাবে। তার কবিতার সাথে একবার পরিচিত হলেই অন্য কবিতা থেকে তাকে আলাদা করতে পারবে যে কোনো সাধারণ পাঠকও।
খুব সহজ ও সুন্দর সুন্দর উপমায় গঠিত কবিতাগুলো কথা বলে, মা, মাটি ও মানুষের পক্ষে। মানবতার ডাক তার কবিতার প্রতিটি বাক্যে। দেশের সবুজ শ্যামল প্রকৃতির বর্ননাও তিনি এঁকেছেন অন্যদের থেকে একটু আলাদা স্বরে আলাদা ধাচে। এটাই তার কবি শক্তির প্রধান পরিচয়।
বাছুরের গলায় ঝোলানো কিশোরীর ঘুঙুর,
কিশোরীদের পায়ে পায়ে সাদা বালুর
ঠিকরে বেরুনো সোনার আলোক।
কবি তার কবিতায় উপমা, উৎপেক্ষা, রূপকের বিশেষ ব্যবহারে সফল। যা কবিকে বাংলা কবিতার জগতে স্থায়ী আসনে বসাবে বলে আমার বিশ্বাস।

৩ thoughts on “ফারুক আফিনদীর ‘হিম নাকি তাপিত রে মন’: কিছু নতুন কাজ।। আহমেদ উল্লাহ্

  • ডিসেম্বর ৬, ২০২০ at ৫:৩৪ অপরাহ্ণ
    Permalink

    অসংখ্য অভিনন্দন কাব্যশীলনকে
    পাশে রাখবেন, পাশে থাকব।
    কৃতজ্ঞ।

    Reply
    • ডিসেম্বর ৬, ২০২০ at ৫:৩৫ অপরাহ্ণ
      Permalink

      অসংখ্য অভিনন্দন কাব্যশীলনকে
      পাশে রাখবেন, পাশে থাকব।
      কৃতজ্ঞ।

      Reply
  • ডিসেম্বর ৮, ২০২০ at ২:০৩ অপরাহ্ণ
    Permalink

    ধন্যবাদ কাব্যশীলন ও আলোচক আহমেদ উল্লাহকে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *